বের্টোল্ট ব্রেশট-এর ১২৫-তম জন্মবার্ষিকী স্মরণে কল্যাণী নান্দনিক-এর ৪৩-তম বর্ষ পূর্তি-র প্রাক্কালে কল্যাণীর ঋত্বিক সদনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তাদের তিনদিন ব্যাপী নাট্যোৎসব। কল্যাণীর বরিষ্ঠতম নাট্যদল কল্যাণী নান্দনিক। ১৯৮০ সালের ১৫ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় কল্যানী নান্দনিক। নাটক ও মূকাভিনয়ে চর্চার ইতিহাসে কল্যাণীতে, কল্যাণী নান্দনিকই সর্বপ্রথম নাট্যদল বলে জানালেন, নান্দনিকের প্রাণপুরুষ কাজল মহান্ত।
ইতিমধ্যে পূর্ণ দৈর্ঘ্য এবং স্বল্প দৈর্ঘ্য মিলিয়ে তারা মঞ্চস্থ করে ফেলেছেন শতাধিক প্রযোজনা। তাদের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা গুলোর মধ্যে অন্যতম মুন্সী প্রেমচাঁদ এর কফন অবলম্বনে দানসাগর, সেপারেশন, এবং মাছি, শক্তিমান, বাবালীলা, সাজানো বাগান, শেষ রক্ষা, যদি আর এক বার, আততায়ী প্রমুখ।
৭ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এই নাট্যোৎসব। নান্দনিক এর অতিহ্য অনুযায়ী ঘড়ির কাঁটা মেনে প্রতিদিন অনুষ্ঠান শুরু হয় ঠিক বিকেল ৫ টা বেজে ৫৩ মিনিটে। ৭ এপ্রিল উৎসবের প্রথম দিন মাঙ্গলিক প্রদীপ জ্বালিয়ে নাট্যোৎসবের শুভ সূচনা করেন কল্যাণী পুরসভার পৌরপ্রধান ড. নিলিমেশ রায় চৌধুরী।
এদিনের প্রথম নিবেদনে ছিল কল্যাণী নান্দনিক-এর নাটকের গান। অংশগ্রহণে ছিলেন তিয়াসা সামন্ত, অরিত্রী কর্মকার, লিপিকা ঘোষ, দেবকন্যা দাস, সুনীতা দাস, পিন্ধি ঘোষ, শিউলি সিকদার, মালা মুখার্জী, শিপ্রা পাল, শিখা তরফদার, শ্যামলী দাস, সুজিত অধিকারী ও অমরেশ মুখার্জী। দ্বিতীয় নিবেদনে ছিল নৈহাটি স্পার্টান রেপার্টরি'র নাটক 'মন' (নাট্যকার-সৌমিত্র বসু, নির্দেশনা -দেবব্রত শর্মা)। প্রথম দিনের শেষ নিবেদনে ছিল কল্যাণী নান্দনিক-এর নাটক 'দাড়ি চড় এবং' (নাটক ও নির্দেশনা-কাজল মহান্ত)।
৮ এপ্রিল উৎসবের দ্বিতীয় দিন মঞ্চস্থ হয় তিনটি নাটক। প্রথমেই ছিল বগুলা সূচনা'র নাটক 'বাণিজ্য' (নাট্যকার-ইন্দ্রাশীস লাহিড়ী, নির্দেশনা- সৃজন)। এরপর কাঁচরাপাড়া ফিনিক এর নাটক 'ওরা নন্দিনীরা' (নাট্যকার-শিবঙ্কর চক্রবর্তী, নির্দেশনা-কাবেরী মুখার্জী)। শেষ নিবেদনে ছিল কল্যাণী নান্দনিক-এর নাটক
'দূর আকাশের নেশায়' (নাটক ও নির্দেশনা-কাজল মহান্ত)।
৯ এপ্রিল নাট্যোৎসবের শেষ দিনের প্রথম নিবেদনে ছিল কল্যাণী নান্দনিক-এর ছোট ও বড়দের মূকাভিনয় এরপর শ্রুতিনাটক
'মধু গন্ধে ভরা'। এদিনের শেষ নিবেদনে ছিল কল্যাণী নান্দনিক এর নব তম প্রযোজনা, পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক 'বেগানা' (মঞ্চ নাটক ও নির্দেশনা-কাজল মহান্ত)।
বেগানা নাটকের সারাংশ
গল্পের মূল চরিত্র পাপড়ি (শিউলি শিকদার) অবিবাহিত, টিলা খাদান অঞ্চলের একটি প্রায় পরিত্যক্ত, সরকার অবহেলিত প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। জায়গাটার নাম পাথর-টিলা। বাস্তবিক খণ্ডহর এলাকা। আগে এখানে একটি ছোট স্টেশন ছিল। কিন্তু লোকসানের কারণে সরকার দ্বারা স্টেশনটি পরিত্যক্ত হয়। এলাকার মানুষরা কর্মহীন হয়ে পড়ে। চাষ-আবাদ নেই। ব্যবসা নেই। পুরুষ-মহিলাদের ন্যূনতম কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। ফলতঃ এলাকার মানুষরা হীন, দরিদ্র, অবহেলিত। এলাকার মহিলারাই বিকল্প কাজের খোঁজ করতে গিয়ে আদিম ব্যবসায় নেমে পড়ে।
ছেলে-মেয়েদেরকে ঘরের পুরুষদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এলাকার বিবাহিত-অবিবাহিত মেয়েরা নিজেদের শরীর বিক্রী করে, কুড়ি কিলোমিটার দূরের পাকুড়ডিহা কোলিয়ারি থেকে আগত বাবু-কুলি পুরুষদের আদিম কামনা মেটানোর তাগিদে।
সুগত (কাজল মহান্ত) পাকুড়ডিহা কোলিয়ারির অফিস ক্লার্ক। সে পাপড়ির থেকে কয়েক বছরের বড়। ডিভোর্সি দায়হীন পুরুষ। সুগতর সাথে একই স্কুল ইউনিভার্সিটি-তে পড়তো পাপড়ি। পুরনো পরিচয়ের সূত্রেই হঠাৎ করে গত একবছর আগে, নতুন করে সুগত-পাপড়ির আলাপ। কুড়ি কিলোমিটার দূর থেকে সুগত প্রায় সন্ধ্যায় চলে আসে পাপড়ির কাছে। লিভ টুগেদার এর দোহাই দিয়ে পাপড়ির শরীরটাকে ভোগ করাই তার আসল উদ্দেশ্য। তবে পাপড়ি, কোনভাবেই সুগত-কে অবৈধ-অনৈতিক সুযোগ নেওয়ার সুযোগ দেয়না। পাপড়ির স্কুলের সহকর্মী মনোজ। তাকে দেখা যায়না নাটকে। সুগত, পাপড়ির সহকর্মী মনোজকে হিংসা করে।
আর দুটি প্রধান চরিত্র কুহকী (লিপিকা ঘোষ) ও মরণ বুড়ো (দেবাশিস রায়)। কুহকীও নিজের শরীর বেচে। মরণ বুড়ো নিজের কন্যাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও শরীর বেচতে উৎসাহ দেয়, শুধু পেটের তাগিদ মেটানো আর অন্যতর এক মহান কাজের উদ্দেশ্যে। এক মহান উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে কুহকীর কাজে। অপ্রধান দুটি চরিত্র রয়েছে নীপা (দেবকন্যা দাস) আর তপন (সাহিল বাঁশফোড়)। কলেজ পড়ুয়া দুটি ছেলে-মেয়ো। এরা গুগল সার্চ করে এই তল্লাটে এসে পড়েছে, শর্ট ফিল্ম বানাবার উদ্দেশ্য নিয়ে। একটা সময় প্রকাশিত হয়, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ কোন এক অপরাধ সংগঠিত করার। নাটকের শেষ দৃশ্যে সুগতর বেধড়ক প্রহারে, সুগতর কাছে বিশ্বাসঘাতক মরণ বুড়ো লুটিয়ে পড়ে পাপড়ির সামনেই। এরপর ঘটনা এগোতে থাকে অতি দ্রুততায়। নাটকীয় প্রবাহ বাঁক নিয়ে নেয় পাপড়ির প্রতিরোধ সত্ত্বেও। কালিমালিপ্ত বিষাদ আর শোক গ্রাস করে কুহকী আর পাপড়িকে। তবু পাপড়ি জাগিয়ে রাখে তার স্বপ্নকে। অবাঞ্ছিত ঘটনাকে সাক্ষী রেখেই এক অজানা, বেগানা, বিরল লড়াই-এর প্রস্তুতির জন্য শপথবদ্ধ হয় পাপড়ি।
অভিনয় করেছেন, সাহিল বাঁশফোড়, দেবকন্যা দাস, লিপিকা ঘোষ, শিউলি শিকদার, দেবাশিস রায় ও কাজল মহান্ত। সঙ্গীতের দায়িত্ব সামলেছেন লিপিকা ঘোষ।
আবহ : দেবাশিস দাস
আবহ মনোজ প্রসাদ (বাবুয়া) নাটক, মঞ্চ ও নির্দেশনা : কাজল মহান্ত
No comments:
Post a Comment